মেঘ-মিলন ।। পর্ব-৪


রেস্টুরেন্টে বসে আছি আমি আর গালিব। আমার দৃষ্টি শুধু এদিক সেদিক। দেখছি কেউ ফলো করছে কি না। কিন্তু আশেপাশে তেমন সন্দেহ ভাজন কাউকে দেখলাম না। গালিব কে কিছু কথা বলা দরকার। ওর থেকে মুন্নীর জীবন বৃত্তান্ত জানার প্রয়োজন।আমার ধারণা গালিব মুন্নীর সম্পর্কে অনেক কিছু জানে।

--গালিব?
--হুমম।
--মুন্নি মেয়েটা কেমন রে?
গালিব মুন্নি নামটা শুনতেই বিষম খেয়ে উঠলো। আমি পানি এগিয়ে দিলাম। পানি খেয়ে একটু পর শান্ত হলো।
--হঠাৎ মুন্নি আপু সম্পর্কে জানতে চাইছিস কেন?
--না মানে এমনি।
--ভালো।
--তাহলে যে বললি "তাকে দেখলে ডিপ্রেশনে পড়ে যাই" কেন ডিপ্রেশনে পড়িস?
--তুই সেই কথা ধরে এখনো  বসে আছিস? বাদ'দে তো।।
--তুই যদি এখন আমার থেকে কিছু লুকোনোর চেষ্টা করিস তাহলে কিন্তু ভবিষ্যতে বেশ সমস্যা হবে। 
--নাহ্ তেমন কিছু না। সে একটু বদ টাইপের আরকি।
--শুধু একটু?
--আমার কাছে একটু মনে হচ্ছে। 
--তুই কি জানিস আনাস আসার সাথে সাথে সে বিপদে পড়বে?
--হতে পারে।
--তোর এসব ডং ভালো লাগছে না।আমার কি মনে হচ্ছে জানিস?
--কি মনে হচ্ছে তোর?
--তুই কোনোদিক দিয়ে মুন্নির কাছে আটকা পড়ে আছিস।
গালিব একটু নড়ে চরে বসলো।
--আরে দূর,আমি মুন্নির কাছে ধরা থাকবো কেন?
--সেটা তুই ভালো জানিস। পড়ে যদি শুনি কিছু তাহলে তোর খবর আছে।
--তখন দেখা যাবে।
--দেখিস কিন্তু?
--হুম।

{বিঃদ্রঃ গত পর্বে ছোট্ট একটা ভুল ছিলো। মেঘ যখন মুন্নীর পরিচয় জানতে চেয়েছিলো তখন গালিব বলেছিলো, বড় মামার বড় মেয়ে। আসলে পরিচয়টা হবে জেঠুর বড় মেয়ে। মানে মেঘের মামাতো বোন}

গালিব আমার থেকে দিব্যি কথা লুকাচ্ছে। তবে সে সহজে কথা লুকানোর ছেলে নয়। এর পিছনে রহস্যটাও বের করতে হবে।আর মুন্নির বেপারের সব তথ্য আমাকেই বের করতে হবে।মুন্নি কোনো সাধারণ মেয়ে নয়।  "ট্রাঙ্কুলাইজার" এটা হচ্ছে দ্রুত ঘুমানোর ঔষধ। এটা সাধারণত ছিন্তাই কারিরা ব্যবহার করে।খারাপ কাজেই বেশি ব্যবহৃত হয়।  পুরো মার্কেট ঘুরে পেলাম না কোথাও। 

বেশ টেনশনে আছি। এই স্প্রেটা ছাড়া মিশন সম্পূর্ণ অচল। সব প্লেন মাটি হয়ে যাবে। আর এই দিকে গালিবও রহস্য কিছু আমাকে বলছে না। কিন্তু তার ভাবে বুঝা যাচ্ছে সে সব জানে। এখন কি করি? দেখা যাক সকালে কি হয়। গালিব ড্রাইভ করছে আমি জানালা দিয়ে আনমনে তাকিয়ে আছি। হুট করে মনে হলো বাসের সেই কাজল চোখের মায়াবতীর কথা।এখনো সেই মেয়েটির কথা ভুলিনি সেটা ভেবেই আশ্চর্য লাগছে।

মেয়েটি বাস থেকে নেমে কোন মহাশুন্যে হাড়িছে কে জানে? খুব করে ইচ্ছে করছে মেয়েটির সাথে আরেকবার দেখা হোক। কিন্তু বিধাতা সহায় না হলে এটা কোনোভাবে সম্ভব না। সেই অদ্ভুত স্পর্শ এখনো মনে সারা ফেলে যাচ্ছে। এতো চিন্তার মাঝে কিভাবে সে আমার কল্পনায় আসে সেটা ভেবে কূল পাই না।  গালিবের কথায় ধ্যান ভাঙ্গলো।গালিব বললো...

--আমার মনে হয় ফুপির সাথে তোর পাঙ্গা নেওয়া ঠিক হবে না।
--কেন?
--সে একজন এমপি।
--কেন যে এটা আগে জানতে চাইলাম না।তাহলে এতো কষ্ট করতে হয় না।।
--তোকে আমি কমপক্ষে ৫০ বার বলতে চেয়েছি। যখনি পরিবার নিয়ে কিছু বলতে যাই  ধমক দিয়ে উঠিস।কার এতো ঠেকা পরেছে তোকে বার বার বলতে গিয়ে ধমক খাওয়ার? 
--অন্তত এটা বলতে পারতি তরী বোবা।
--সেটা বলিনি আমি ইচ্ছে করেই।
--কেন? 

গালিব চুপ হয়ে গেলো। গালিবের এসব আচরণ মোটেও ভালো লাগছে না। তরী বোবা এই নিউজটা কেন সে গোপন রাখবে? এর পিছনে আবার কি কারন লুকিয়ে রয়েছে? সব থেকে উত্তম কাজ হবে মেজাজ শান্ত রেখে গালিব কে আর এই সম্পর্কে কিছু না বলা। পরে কোনো এক সময় সে নিজেই বলবে। 

--আচ্ছা গালিব নদীর ঐ পারে যেতে কতক্ষণ সময় লাগবে? 
--কেন যাবি সেখানে?
--যাবো না। তবুও জানতে চাই আরকি।
--যাবি নাকি?  চল ঘুরে আসি?
--না, আজকে না। এমনি খুব টায়ার্ড আমি।
--ঠিক আছে,বাসায় গিয়ে রেস্ট নে।
--আর একটা কথা,
--কি?
--আমি যে মেঘ সেটা যেন তরীও না জানে।
--ওকে।

আমার দিকে বাড়ির অনেকে আদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। হয়তো গালিবের ফ্রেন্ড হিসেবে আগে কেউ দেখেনি সেই জন্য। গালিব আমাকে রুমে রেখে কোথায় যেন চলে গেলো। টায়ার্ড হলেও ঘুম আসছে না।
'গালিব", "গালিব" ডাকতে ডাকতে কে যেন গালিবের রুমে আসছে। মহিলা কন্ঠ শুনা যাচ্ছে।কিন্তু গালিব তো রুমে নেই। একটা গেইম খেলা যাক। আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। 

--এই গালিব?
--হু..
--তুই ঘুমাচ্ছিস, আর এই দিকে এলাহি কান্ড ঘটে যাচ্ছে। মেঘ নাকি বাংলাদেশে এসেছে। আজকালের ভিতরে এখানে আসতে পারে। এখন আমাদের কি হবে? 

কি উত্তর দিবো সঠিক বুঝতে পারছি না। আমার মনে হয় নিরব থাকাটা বেটার। এটা সম্ভবত মেজো মামি। 
--জনমের ঘুম ঘুমা।মেঘ আসলে তরীর বিয়েটাও বন্ধ হবে। না, ভালো লাগছে না এসব।  মেজো মামি বকবক করতে করতে চলে গেলো। 

আমি মুখ থেকে কম্বল সরিয়ে নিরব হয়ে আছি। বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে!সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আমার উপস্থিতি সবার নিদ্রাহীনতার কারন? তবে কেন? একদিকে মামাতো বোন মুন্নি আমাকে মারার প্লেন করছে।এই দিকে মামি কি সব বলে গেলো?কে জানে তাদের দলে আর কে কে আছে? নাহ্ ঘুমালে চলবে না। একটু হাঁটাচলা করি। 

আমি চলে আসলাম ডেকোরেশনের লোকদের কাছে। ওরা বাড়ি সাজাতে ব্যস্ত।কে জানে কবে থেকে শুরু করেছে। এতো বড় বাড়ি মুখের কথাও নয়।আমি একটা চেয়ারে বসে আছি। কাজ না করলেও চলবে। যেহেতু পরিচয় আমাদের ডেকোরেশন। আমার দৃষ্টি শুধু আশেপাশের লোকদের দিকে।এখন অবশ্য মানুষের ততো আনাগোনা নেই। সবাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়ছে। নাহ্ বসে থেকে কাজ নেই। আনাস না আসা পর্যন্ত আর কোনো কিছু করতে পারবো না।

রুমে এসে দেখি গালিব বিষন্ন মনে বসে আছে।কে জানে আবার কি হয়ছে।জিজ্ঞেস করবো নাকি একবার? না থাক।ওরে জিজ্ঞেস করলেও যেই, না করলেও সেই। কোনোকিছু বলবে না।অযথা সময় নষ্ট না করে ঘুমিয়ে পরি। সকালে কারো হাতের ধাক্কায় ঘুম ভাঙ্গলো। হকচকিয়ে উঠতেই দেখলাম তরী।আমাকে দেখে সে আতকে উঠলো। হাতে তার চায়ের কাপ। মুখে বিষন্ন ভাব। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না।কাল বাদে পরশো যার বিয়ে সে এখনে কেন? 

আবার চায়ের কাপ হাতে। আমার বোনটাকে কি সবাই দাসী বানিয়ে রেখেছে নাকি? বুঝতে পারছি না কিছু।তরী আমাকে ইশারায় বুঝাচ্ছে গালিব কোথায়?  আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম গালিব নেই।
ইশারায়, বললাম জানিনা। তরী চা নিয়েই উল্টোদিক হয়ে হাঁটা ধরলো।  আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। বেগ থেকে ব্রাশ বের করলাম। বারান্দায় হাঁটা হাঁটি করছি।এটা আমার অভ্যাস। পুরনো ঐতিহ্যের পোষাক লুঙ্গি পড়েছি। একটা সেন্টি গেঞ্জি পড়নে গলায় একটা গামছা।  আমি এক মনে বাহিরের দিকে তাকিয়ে দাঁত ব্রাশ করছিলাম।

পিছন থেকে কে যেনো কাঁধে হালকা হালকা স্পর্শ করে বললো...
--এই যে মে মে মিরাজ। 
চমকে গিয়ে পিছনে তাকালাম। অচেনা একজন মেয়ে। আগে কখনো দেখিনি। তবে সে মে মে মিরাজ জানলো কি করে? 
--গুড মর্নিং।
--হুমম। কিন্তু আপনি কে?
--খুব আশ্চর্য ধরনের লোক আপনি। গুড মর্নিং বললাম আপনি শুধু হু বললেন।
--আমি শুধু হুম বলিনি।আপনি কে সেটাও জিজ্ঞেস করছি।
-- আমার নাম প্রমা চৌধুরী।
এই নামটা কোথায় যেন শুনেছি? সঠিক মনে আসছে না। 
--কি ভাবছেন? 
--না কিছু না।
--আপনি কি সত্যি ডেকোরেশনের লোক?
--সন্দেহ আছে নাকি?
--একটু একটু।
--আমাকে কি মনে হয়? 
--না আপনার স্টাইল ফরেনারদের মতো।তাই বললাম।
--বিদেশিরা লুঙ্গি পড়ে?
--সেই বিদেশি বলিনি।মানে আপনি বোধহয় দীর্ঘদিন বিদেশ ছিলেন।
--কে আপনি? 
--প্রমা চৌধুরী। 

আমি কিছু বলার আগেই গালিব দৌড়ে আসলো।  
--সর্বনাশ হয়ে গেছে। 
--কি হয়েছে?
--তারাতাড়ি হাত মুখ ধোঁয়ে আস।
--কি হইছে বলবি তো?
--আগে হাত মুখ ধোঁয়ে আস?
অতি দ্রুত ফ্রেস হয়ে আসলাম গালিব দুই হাত পিছনে আটকে এদিক সেদিক যাচ্ছে। আমার অপেক্ষা করছে।
--কি হয়েছে বলবি তো?
--মেঘ চলে এসেছে। 
--তাতে সমস্যা কি?
--নিচে গেলেই দেখতে পারবি সমস্যা কোথায়। 

আমি গালিবের পিছনে পিছনে যাচ্ছি।আমার পিছনে  আসছে প্রমা নামের মেয়েটা। যাক আনাস চলে এসেছে।এবার একে একে সব রহস্য বের করবো।কিন্তু গালিব এতো ভয় পাচ্ছে কেন?নিচে গিয়েতো রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কে এটা! আনাস কোথায়!এটা আবার কে!ও মাই গড! আগে কোথায় দেখেছি বলে মনে হয় না। 

আমার সমবয়সী একটা ছেলে। আমার থেকে অনেকটা মোটা।  বেশ স্টাইলিশ।কিন্তু কথা হচ্ছে এইটাকে আবার কে আমদানি করলো?গালিব আমার দিকে তাকাচ্ছে, আমি গালিবের দিকে তাকাচ্ছি।  হঠাৎ মনে হলো এখন আবার আনাস চলে আসবে। ওদের থেকে একটু আড়ালে গিয়ে আনাসকে ফোন দিলাম। একটু পর রিসিভ করলো।
 
--কোথায় তুই?
--পথে।
--যেখানে আছিস সেখানেই থেমে যা।
--কেন?
--বাড়ি চলে যা। প্লেন উল্টো পাল্টা হয়ে গেছে। আল্লাহ জানে এখন কিভাবে কি করবো।
--আচ্ছা ঠিক আছে। 

আমি ফোন কেটে দিয়ে আবার গালিবের পিছনে এসে দাঁড়ালাম। ছেলেটা এক হাত দিয়ে আম্মুকে জরিয়ে ধরে আছে। সবার সাথে পরিচিত হচ্ছে। আম্মুতো রীতিমতো এক্টিং শুরু করে দিয়েছে।নাকের জল চোখের জল এক করে ফেলছে। আমার কেন যেন বিরক্ত লাগছে ওনার এক্টিং গুলো। তরীকে দেখলাম একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে।

মনে হচ্ছে ভাই হিসেবে ছেলেটাকে সে মানতে পারছে না। এমনি কাল রাত থেকে রহস্যে রহস্যে একদম শেষ হয়ে যাচ্ছি।এর মাঝে আমদানি হলো আরেক জিনিস।কোথায় আমি খেলবো সবাইকে নিয়ে সে যায়গায় সবাই আমাকে নিয়ে খেলছে। এটা নিশ্চয়ই মুন্নীর কাজ। ছোট মামাকে চিনতে অসুবিধে হলো না। কোথায় থেকে এসে যেন ছেলেটার কাছে গিয়ে হেঁসে হেঁসে বলছে...

--এটা আমার সেই পিচ্চি ভাগ্নে মেঘ?
ছেলেটা বললো,
--হ্যা মামা।আমিই মেঘ।

এতো কনফিউশনের মধ্য দিয়ে পেট ফেটে হাঁসি আসছে।মনে মনে বললাম, হ্যা ভাই তুই মেঘ।আমি এলিয়েন। ডান দিকে তাকিয়ে দেখি প্রমা নামের মেয়েটা দুই হাত বুকে গুটিয়ে আমার দিকে ঘার বাকা করে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাঁসি হাঁসছে।এবার সন্দেহ হতে লাগলো মেয়েটাকে নিয়ে। ওর ভাব ভঙ্গি একদম ভালো লাগছে না।কে এই মেয়ে? এই নকল মেঘ চরিত্রের সাথে সে জরিত নয়তো?


লেখক: নিহান আহমেদ আনিছ

Post a Comment

Give your opinion, please!

নবীনতর পূর্বতন