ভালোবাসার শক্তি
পর্ব:-৬
--উনি শিকল ছিড়ে ফেলেছেন, যার পক্ষে শিকল ছেড়া কোন ব্যাপারই না, সে কেনো এতোদিন যাবত শিকলে বন্ধি আছে? ব্যাপারটা একটু ভাবুন।(প্রিয়া)
--হুম তাইতো,,, (আয়েশা বেগম)
--মা, আমার মনে হচ্ছে আমাদের চোখের আড়ালে কিছু একটা হচ্ছে।
--কি হচ্ছে?
--এই ভাইরাস যাকে ধরে সে নিজেও জানে না সে কি করে... তাহলে উনি তখনো কেনো আমাদের ক্ষতি করে না? আমাকে জানতেই হবে......
প্রিয়া রেগে আবার মামুনের কাছে চলে যায়। মামুন চোখ বন্ধ করে স্বাভাবিক ভাবে শুয়ে আছে মামুনের ওই মুখটার দিকে তাকিয়ে প্রিয়া যেনো সব ভুলে যায়। দরজার সামনে দাড়িয়ে প্রিয়া অপলক দৃষ্টিতে মামুনের দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে প্রিয়া মামুনের পাশে গিয়ে বসে। মামুন চোখ খুলে
প্রিয়ার দিকে তাকায়। হঠ্যাৎই মামুন শিকল টানাটানি শুরু করে। প্রিয়ার চোখের দিকে তাকিয়েই এমন করছে। প্রিয়া বুঝতে পারে প্রিয়ার চোখে পানি এজন্যই কি মামুন এমন করছিলো? সাথে সাথে প্রিয়া চোখের পানি মুছে ফেলে। মামুনও শান্ত হয়ে যায়। প্রিয়া মামুনকে জড়িয়ে ধরে আবার কেঁদে দেয়।
--আপনি কেনো আমাদের সাথে এমন করছেন? কি হয়ছে আপনার? কেনো আমাদের কষ্ট দিচ্ছেন?
--
--এতো কষ্ট না দিয়ে আমাদের মেরেই ফেলুন, আপনাকে এভাবে আর দেখতে পারছি না। একজন স্ত্রীর সামনে তার স্বামী শিকল দিয়ে বাঁধা, এরচেয়ে বড় কষ্ট আর কি আছে?
আমি আপনার শিকল খুলে দিচ্ছি, এরজন্য যদি আমাকে মরতে হয়, তাতেও আমার কোন আপত্তি নেই।
মামুন শিকল সরিয়ে ফেলছে, কোন ভাবেই শিকল খুলতে দিচ্ছে না। প্রিয়া জোর করে মামুনের শিকল খুলে দেয়। মামুন দৌড়ে মায়ের কাছে যায়, ওনার হাত ধরে টেনে শিকলের কাছে নিয়ে যায়, হাতদুটো সামনের দিকে বারিয়ে দেয়।
--না মা, ওনাকে আর শিকল লাগাবেন না।
--কি হয়েছে বৌমা?
--আমি দেখতে চাই উনি ওনার পরিবারের জন্য কি করতে পারেন। আপনি শিকল লাগিয়ে দিবেন না।
মামুন বার বার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, কিন্তু প্রিয়া শিকল লাগাতে দিচ্ছে না।
হঠ্যাৎই মামুন কেমন যেনো করতে থাকে, ওর শরীর আবার ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। প্রিয়ার কেনো যেনো মনে হচ্ছে এই মানুষটার শরীরে অন্য আরেকটা প্রান প্রবেশ করছে। মামুন হঠ্যাৎই প্রিয়া আর মাকে টেনে দরজার বাহিরে বের করে দরজা লাগিয়ে দেয়। প্রিয়া অনেক ধাক্কাধাক্কি করে, কিন্তু মামুন দরজা খুলে না। ভেতর থেকে প্রচুর শব্দ বের হচ্ছে, সেই আগের গর্জন।
পুরোদিন আর মামুন দরজা খুলেনি। সন্ধ্যায় দরজাটা খুলে দেয়। প্রিয়া রুমে গিয়ে দেখে পুরো রুম উল্টা-পাল্টা করে ফেলেছে। মামুন বিছানায় বসে আছে। প্রিয়া বকাবকি করতে করতে পুরো রুম আবার ঠিক করে।
--আমার এই শরীর নিয়েও আমাকে এতো কাজ করাচ্ছেন, আপনি না আমার স্বামী? আপনার লজ্জা করে না?
--
--কি হলো? কথার জবাব দিন।
--(মামুন শিকলটা ওর হাতে পায়ে লাগিয়ে দেওয়ার জন্য ইশারা করে)
--একদম না, আপনাকে আর শিকল লাগাবো না। দেখি আপনি আর আমাকে কত কষ্ট দিতে পারেন।
--(মামুন প্রিয়ার আচল ধরে ইশারায় অনুরোধ করছে)
--ঘরে বাজার শেষ, বাজার করে দিতে পারবেন? তাহলে লাগিয়ে দিবো।
--(মামুন সোজা পাকের ঘরে গিয়ে বাজারের ব্যাগটা নেয়)
--আরে আরে, কই যান? দাড়ান....
--(মামুন দাড়ায়)
--কথা দেন আপনি কোন সাধারন মানুষের ক্ষতি করবেন না।
--(মামুন চুপচাপ দাড়িয়ে আছে)
--আমার আপনার ওপর পুরো বিশ্বাস আছে। দাড়ান......
প্রিয়া একটা কাগজে জিনিসপত্রের নাম লিখে দেয়। এবং সেই পরিমান টাকা দিয়ে দেয়।
--এটা শুধু দোকানদারের হাতে দিবেন, তাহলে দোকানদার আপনাকে বাজার দিবে। যান.....
মামুন এটা নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলো।
--এটা কি হলো বৌমা? (আয়েশা বেগম আসলো)
--ওনাকে বাজার আনতে পাঠিয়েছি।
--ও দেখি তোমার কথা শোনে....
--হুম, শিকলটা লাগিয়ে দেওয়ার জন্য।
--লাগাতে দেওনা কেনো?
--না মা, শিকল আর লাগাবো না,,, আমি বুঝতে পারছি ওনার ধীরে ধীরে আগের থেকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
--কিন্তু এখন যে বাহিরে গেলো, যদি কারো ক্ষতি করে ফেলে?
--কারো কিচ্ছু করবে না।
--কেনো কারো কিছু করবে না?
--কারন এই ৭-৮ দিনে একবারও এই সন্ধ্যা বেলায় উনি ভারসাম্য হারাননি...।
--বৌমা, তোমার জন্য আমার ছেলেটার ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে।
--দোয়া করেন মা।
৩০ মিনিট পর মামুন বাজার নিয়ে বাসায় হাজির, প্রিয়ার হাতে বাজারের থলেটা দেয়।
--কারো কোন ক্ষতি করেননি তো?
--(মামুন চুপচাপ দাড়িয়ে আছে)
হঠ্যাৎ প্রিয়ার হাত ধরে ওকে শিকলের কাছে নিয়ে যায়, হাতদুটো সামনের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
--না, আপনাকে আমি শিকলে আর বাঁধতে পারবো না।(প্রিয়া)
মামুন যেনো কষ্টে চিৎকার করছে। কিন্তু প্রিয়া শিকলে বাঁধছে না।
--আমি জানি, আপনি ভয় পাচ্ছেন, আমাদের কারো ক্ষতি হয়ে যাবে আপনি এই ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু আপনি চান না আমাদের কারো ক্ষতি হোক। চাইলেই আপনি পারবেন নিজেকে সামলাতে। শিকলের কোন প্রয়োজন নেই।
মামুন জোরে চিৎকার করতে থাকে। মামুনের চিৎকার শুনে আয়েশা বেগম ছুটে আসে।
--কি হয়েছে আমার ছেলের?
মামুন মাকে শিকলের কাছে নিয়ে যায়।
--না মা,,, আপনি শিকল লাগাবেন না।(প্রিয়া)
মামুনের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আয়েশা বেগম ছেলের কান্না দেখে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে নিজেও কেঁদে দেন।
--বাবা, তুই কাঁদাছিস? কেনো???
মামুন বার বার শিকলের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।
--বৌমা, আমার ছেলে কাঁদছে, ওকে আর কাঁদাইও না, তোমার কাছে হাত জোর করছি, আমার ছেলেকে কাঁদাইও না।
--মা, কি করছেন আপনি? ওনাকে যদি সুস্থ করতে হয় তাহলে এছাড়া আর কোন উপায় নেই। উনি আমার স্বামী, আমার কি কষ্ট হচ্ছে না?
--বাবা, তুই আবার আগের মতো ঠিক হয়ে যাবি, একটু কষ্ট কর। আমরা আছি তোর সাথে। তোর কিচ্ছু হবে না।
মামুন বিছানায় বসে পড়ে, আগের থেকে এখন অনেকটা সুস্থ। এখন প্রিয়াকে চেনে, মাকে চেনে। ওর শুধু একটাই ভয়, যখন ও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে তখন মা আর প্রিয়ার যদি ক্ষতি হয়ে যায়? কথা বলতে পারলে হয়তো তার ভেতরের কথা জানা যেতো। রাতে প্রিয়া ওকে আবার নিজের হাতে খাইয়ে দেয়। মামুন আজ শিকল মুক্ত, প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে।
--ঘুমাবেন না?
--
--আপনি আমাকে কতোটা ভালোবাসেন?
--(মামুন মুখ ফিরিয়ে নেয়)
--কি হলো? আমাকে ভালোবাসেন না?
--
--বাসেন বাসেন, ভালো না বাসলে আপনার আমানতটা কোথায় থেকে আসলো?
--
--জানেন? আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি।
--
--কি হলো আপনার? আমার দিকে তাকান....
--
--আমার ওপর রাগ করেছেন?(মামুনকে জোর করে প্রিয়ার দিকে ঘুরায়)
--
--হুম বুঝেছি। এই যে কানে ধরে ক্ষমা চাচ্ছি....সরি....
--(মামুন হালকা হাসে)
--আপনিকি পারবেন সুন্দর ভাবে আজ রাতটা পার করতে?(প্রিয়া)
--
--যদি পারেন তাহলে কাল আপনাকে একটা খুশির খবর শুনাবো।
(প্রিয়া বুঝতে পারলো মামুন মনে মনে হাসছে)
প্রতিদিনের মতো মামুনকে জড়িয়ে ধরে প্রিয়া শুয়ে পড়লো। হঠ্যাৎ মধ্যরাতে মামুনের ধাক্কায় প্রিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। প্রিয়া চোখ খুলে দেখে মামুন ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। শরীরের রং বদলে যাচ্ছে, দাঁতগুলো বড় হয়ে যাচ্ছে। প্রিয়া বুঝতে পারে বিপদ হতে চলেছে। কারন আজ শিকল লাগানো নেই যদি মামুনের একটা কামড় বা একটা নখের আচড় প্রিয়ার গায়ে লাগে, তাহলে প্রিয়াও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যাবে।
মামুন কেমন যেনো করছে, তবুও প্রিয়াকে রুমের বাহিরে যাওয়ার ইশারা করছে। কিন্তু প্রিয়া বাহিরে যাচ্ছে না। মামুনের জোরে জোরে শব্দ শুনে আয়েশা বেগম দৌড়ে রুমে আসেন। মামুন পুরোপুরি পশুর রুপ ধারন করে ফেলেছে। আয়েশা বেগম এসে প্রিয়ার হাত ধরে বাহিরের দিকে নিয়ে যেতে চায়, কিন্তু প্রিয়া এক ঝাটকায় হাত ছুটিয়ে নেয়।
--কি করছো বৌমা? বাহিরে আসো। (আয়েশা বেগম)
--আপনি বাহিরে চলে যান, আমি ওনাকে সামলে নিচ্ছি।
--না বৌমা, ও তোমাকে যদি আহত করে ফেলে, তাহলেও তোমার বিপদ। চলে আসো।
প্রিয়া শাশুড়িকে বাহিরে রেখে দরজাটা আটকে দেয়। মামুন এক লাফ দিয়ে প্রিয়ার সামনে চলে আসে। মামুনের এই ভয়ংকর চেহারা দেখে প্রিয়ার ভীষন ভয় লাগে। মামুন প্রিয়ার গলা চেপে ধরে।
প্রিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মামুন এক ধাক্কায় প্রিয়াকে ফেলে দেয়। বাহির থেকে আয়েশা বেগম প্রিয়ার আওয়াজ শুনে দরজা ধাক্কাচ্ছে আর কাঁদছে। প্রিয়া প্রেগন্যান্ট, যদি কোন ধরনের বড় আঘাত প্রিয়ার লাগে, তাহলে হয়তো আজই প্রিয়ার শেষ দিন।
প্রিয়া খেয়াল করলো মামুনের চোখে পানি, কিন্তু চোখগুলো আক্রমণাত্মক ভাবে প্রিয়ার দিকে চেয়ে আছে। প্রিয়া এক পাশে পড়ে আছে, মামুন পুরো ঘর তছনছ করে ফেলছে, জানালার গ্রিল ধরে চিৎকার কারছে। সে কি চাইছে না প্রিয়ার কিছু হোক? তাহলে কেনোই বা প্রিয়াকে আঘাত করছে যেনো মামুনের অনিচ্ছার সত্তেও ওকে দিয়ে কেউ এসব করাচ্ছে।
মামুন একটা ছুরি হাতে নিয়ে প্রিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। হাতে ছুরি দেখে প্রিয়া ভীষন ঘাবড়ে যায়, ছুরি হাতে নিয়ে মামুন এলোপাথাড়ি এদিক ওদিক করতে থাকে। প্রিয়া ধীরে ধীরে পেছাতে থাকে। মামুনও ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। হঠ্যাৎ মামুনের ছুরিটা রক্তে লাল হয়ে যায়, মামুন ধপাস করে ফ্লোরে বসে পড়ে...........
লেখক :- আবদুল্লাহ আল মামুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Give your opinion, please!