বাবা


⏩আগের দিন থেকেই বাবা বাসায় যাবার জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছিলেন। চারদিন হসপিটালে থেকে বাবা আসলে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। আগের রাতে ডাক্তার বলে গেছেন কাল উনার ছুটি। বাবা তাতে খুব খুশি। বাসায় যাবেন এই জন্য।

পরের দিন সকাল থেকে বার বার তাড়া দিচ্ছিলেন বাসায় যাবার জন্য। আমি ডাক্তার আসার অপেক্ষায় বসে আছি। আবার শিওর হতে চাচ্ছিলাম যে আসলেই বাবাকে নিয়ে যেতে পারবো কিনা। ডাক্তার সাহেব সকালের রাউন্ডে এলেন ১১টার একটু পর। দেখে আবারো বললেন বাসায় চলে যেতে। এনজিওগ্রাম করবেন কয়েকদিন পর।

হসপিটালের অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সেরে বাসায় ফিরে এলাম যখন ঘড়িতে তখন সাড়ে তিনটার একটু বেশি।
সবাই খাওয়া দাওয়া করলাম। বাবাকেও খাওয়ানো হলো। শরীর মুছিয়ে উনাকে বললাম একটু ঘুমাতে। আমিও পাশের রুমে গিয়ে একটু ঘুমানোর চেস্টা করছি তখন। গত চার রাতের ধকলটা তখন শরীর জানান দিচ্ছিলো। সম্ভবত ত্রিশ মিনিটের মাথায় বাবা যেন কেমন করে উঠলো। দাদা পাশেই ছিল তখন। দাদা যখন আমাকে ডাকলো আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি একটা খিঁচুনির মত হল বাবার। দুইহাত বুকের কাছে নিয়ে দাঁত মুখ খিচিয়ে ছিলেন কিছুক্ষন। তারপর শরীর নিস্তেজ। আমি শুধু বললাম, ৯৯৯ এ কল দিয়ে এম্বুলেন্স ডাকতে। বাবা বোধয় এর আগে বিড়বিড় করে অনেককিছু বলছিলেন।

আমি তখনো বিশ্বাস করি বাবা আছেন। হয়ত সেন্সলেস। তারপর এম্বুলেন্স নিয়ে দেবাশীষ যখন এলো তখন নিথর দেহ নিয়ে আমরা রওনা হলাম হসপিটালে। রাস্তায় অনেক জ্যাম তখন। পৌছালাম বোধয় ঘন্টাখানেক পর। ডাক্তার দুপুরের ডিসচার্জ ফাইল দেখে শুধু বললেন, এই রোগী কিভাবে বাসায় গেলো, কিভাবে ছুটি হল, আমি ওই ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করব। উনি আসলে রোগীকে পুরো পৃথিবী থেকেই ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। আরো কত কি... 

আমি তখনো বিশ্বাস করি, কোনো মিরাকল হয়ে হলেও বাবার জ্ঞ্যান ফিরে আসবে। বাবা আবার কথা বলবেন। আবার সকালের মত বলবেন, আমি হসপিটালে কেন। আমি বাসায় যাবো।

আমি আশায় আশায় তাকিয়ে আছি ইমের্জেন্সি রুমের মনিটরের দিকে। সেটা ক্রমশ ৮/৯ এইরকম দেখাচ্ছিল। শুধু মনে হচ্ছিল এটা বাড়বে... ডাক্তার যখন ডিক্লেয়ার করল যে আসলে বাবা আর নেই, আমি তখন ঠায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম পর্দার ওই পাশের মনিটরটা এই বুঝি পাল্টাবে। বাবাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল তখন।

কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, এখন কোথায় নিবো বাবাকে?  শুধু বললাম, মাকে যেখানে রেখেছিলাম সেখানে। মহাশ্মশানে। রাস্তায় অনেকটা সময় আমি বাবাকে ছুঁয়ে রেখেছিলাম, বুকের শ্বাস উঠানামার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, বুকে হাত দিয়ে দেখছিলাম। শুধু মনে হচ্ছিল, বাবা কিছু একটা বলবে। বাবার শ্বাস আবার চালু হবে।

বাবা হসপিটালের আইসিইউর বিছানায় শুয়ে ছিলেন তখন বলেছিলাম," বাবার অসুস্থতার পর থেকে আমি তেমন কিছু চিন্তা বা দুশ্চিন্তা করতে পারছিনা। মাথায় কিছু আসছেনা। শুধু মনে হচ্ছে, সারাজীবন নিজের কাজ নিজে করা বাবা যেন যতদিন বাঁচেন ততদিন সব নিজেই করতে পারেন। অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা উনার পছন্দ না এই ৮০+ বয়সেও। সবাই বলছেন এটা ওটা হয়েছে, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে বাবার কিছু হয়নি। আমি প্রতিবার বাবার সামনে গেলেই কথা বলছেন। সবার খোঁজ নিচ্ছেন। "

উনি সেটাই করেছেন। কারো উপর এক মুহুর্ত নির্ভর না করেই চলে গেছেন অন্য কোথাও। এই জাগতিক মোহ আর মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে। গত দশদিন ধরে আমার প্রায় একই রকম অনুভূতি হচ্ছে। উনি কাউকে কিছু না বলে এভাবে চলে যাবেন ভাবতে পারছিনা। শ্মশানের স্নানঘরে যখন স্নান করাচ্ছিলাম তখনো বাবার মুখটা স্বাভাবিক আর শরীরের তাপমাত্রা ঠিক সবসময় যেমন থাকে তেমন।  

বাবা আর নেই এই কথাটা এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা কোনভাবেই। অথচ দশ দিন হয় বাবা চলে গেছেন অন্য কোথাও।

যেখানেই আছেন, ভালো থাকবেন বাবা।🔚

Post a Comment

Give your opinion, please!

নবীনতর পূর্বতন