ভালোবাসার শক্তি
পর্ব:-৪
মামুনের শহরটা চারো দিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়, যেনো এই ভাইরাস নিয়ে কেউ এর বাহিরে যেতে না পারে। এখন মামুনের চাকরিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পুরো শহরবাসী চার দেয়ালের মধ্যে নিজেদের বন্ধি করে রাখছে। যেই শহরটায় সবসময় হৈচৈ, কোলাহল লেগেই থাকতো, তা আজ পুরো শান্ত। মামুন পরিবারের সাথেই আছে। প্রিয়ার ৬ মাস চলছে। মামুন ওর ভালো করে খেয়াল রাখছে।কিন্তু এই সময়টাতে যে নতুন এক বিপদ শুরু হয়েছে।
যারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, তাদের পুরো শরীর ফ্যাকাসে হয়ে যায়। আক্রান্ত ব্যাক্তিরা নিজেরাও জানে না তারা কি করছে, সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই খুন করছে। মামুন প্রিয়াকে এসব বিষয়গুলো ভুলিয়ে রাখে, যেনো মেয়েটা ভয় না পায়। সারাদিন ওর সাথে সময় কাটায়। প্রিয়া খুবই শান্ত স্বভাবের মেয়ে, এতোদিন যাবত এই পরিবারে আছে, কারো সাথে রাগ করাতো দুরের কথা, সামান্য উচু আওয়াজেও কথা বলে নি।
অনেকদিন যাবত এভাবেই চলতে থাকে, মামুনের বাহিরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে, কারন ঘরে প্রায় সব খাবারই শেষ। বাজার করা দরকার, তাই আয়েশা বেগম দোয়া-দুরুদ পড়ে মামুনের সারা শরীরে ফু দিয়ে দেয়। মামুন বাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। প্রিয়া মামুনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।
.
অনেক্ষন হয়ে গেলো, মামুন বাসায় আসছে না। এদিকে আয়েশা বেগম আর প্রিয়ার টেনশনে অবস্থা খারাপ। মামুন সকালে বাজারে গিয়েছে। সকাল গেলো, দুপুর গেলো, বিকাল গেলো, এখন রাত মামুন এখনো বাসায় ফিরে নি। ফোনে রিং হচ্ছে কিন্তু ফোন ধরছে না। প্রিয়া রুমে বসে বসে কাঁদছে। ঘরে পুরুষ বলতে আর কেউ নেই। কে যাবে খুজতে?
আয়েশা বেগম বয়স্ক, প্রিয়া প্রেগন্যান্ট.....
বাহিরে যাওয়াটা তাদের পক্ষে অসম্ভব। অয়েশা বেগম খুবই শক্ত মনের মানুষ। উনি প্রিয়ার সাথেই আছেন। প্রিয়াকে সান্তনা দিচ্ছেন। কিন্তু এভাবে ঘরে বসে থাকলে কিছুই হবে না।
--মা, আমি ওনাকে খুজতে যাবো।(প্রিয়া)
প্রিয়ার এমন কথায় আয়েশা বেগম বেশ অবাক হলেন।
--কি বলছো বৌমা?
--জ্বি, আমি বের হবো।
--কি বলছো তুমি? এই অবস্থায় তুমি বাহিরে যাবে? এটা আমি কখনোই হতে দেবো না।
--মা, আমি না গেলে ওনার খোজ পাবো কি করে?
--তুমি এই শরীর নিয়ে বের হবে না। আমি যাবো আমার ছেলেকে খুজতে।
--না মা, আপনি পারবেন না। আমিই যাবো। আপনার দোয়া আছে আমাদের সাথে। কারো কিচ্ছু হবে না।
--দেখো মা, পাগলামো করো না। বাহিরে খুব বিপদ.....
--আমি আমার স্বামীকে খুজতে যাবো, কোন বিপদ আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। আমি যাচ্ছি।
(বলেই প্রিয়া অায়েশা বেগমকে রেখে একটা টর্চ নিয়ে বেরিয়ে যায়)
এদিকে আয়েশা বেগম চিন্তায় অস্থির, একদিকে ছেলে বিপদে, অন্য দিকে ছেলের বউও একি দিকে হাটলো। কোন উপায় না পেয়ে দোয়া-দুরুদ পড়তে লাগলো।
প্রায় ২ঘন্টা পর...
টিং টিং....
আয়েশা বেগম উকি দিয়ে দেখে মামুন আর প্রিয়া। দ্রুত দরজা খোলে....
প্রিয়ার এক হাতে বাজারের থলে, অন্য হাত দিয়ে মামুনকে ধরে রেখেছে। মামুন প্রিয়ার কাঁধে ভর দিয়ে দাড়িয়ে আছে। তাড়াহুড়ো করে ওদের ঘরে ঢুকায়। আয়েশা বেগম পুরো ঘাবড়ে যান।
--কি হয়েছে আমার ছেলের?
--চিন্তা করবেন না মা, ওনার কিচ্ছু হয় নি। ওনাকে রুমে নিয়ে চলুন...
মামুন মা আর প্রিয়ার কাঁধে ভর দিয়ে রুমে যায়।
মামুনকে শুইয়ে প্রিয়া একটা চেয়ারে বসে পড়ে।
--বৌ মা, তুমি ঠিক আছো?
--হ্যা মা, আমি ঠিক আছি। একটু ক্লান্ত লাগছে......
আয়েশা বেগম মামুনের দিকে তাকিয়ে দেখে মামুন শুধু তাকিয়ে আছে, কোন কথা বলছে না। ওর জামার কোথাও কোথাও ছেড়া। শরীরের কিছু জায়গায় কাটা, ছেড়া, আচড়।
--বাবা, কি হয়েছে তোর?
--(মামুন চুপ)
--কি হয়েছে? কথা বল....
--(মামুন চুপ)
--প্রিয়া, ওর কি হয়েছে? কথা বলছে না কেনো?
--জানি না মা, আমারও কোন কথার জবাব দেয় নি।
--ও কোথায় ছিলো?
--অন্ধকারে একটা গাছের নিচে এই বাজারগুলো নিয়ে বসে ছিলো।
আয়েশা বেগম কিছুই বুঝতে পারছে না ছেলের কি হয়ে গেলো। কেন কথা বলছে না। প্রিয়া মামুনের কাটা ছেড়া গুলো পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। এমনিতেই প্রিয়া অনেক ভীতু। মামুনের আচার আচরন দেখে প্রিয়ার ভয় লাগতে শুরু করে। এদিক ওদিক কেমন করে যেনো তাকায়। যেনো এটা অচেনা একটা ঘর। প্রিয়াও যেনো অচেনা। বোবার মতো থাকে, কোন কথা বলে না। আয়েশা বেগমও খুব চিন্তায় আছেন।
সারা রাত প্রিয়া মামুনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। প্রিয়া যতই ভয় পায় মামুনকে ছেড়ে কোন দিকে যায় না। আয়েশা বেগম মামুনকে দেখতে রুমে যায়। ছেলের পুরো শরীর ধীরেধীরে ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। আয়েশা বেগম বুঝতে পারে ব্যাপারটা কি। সারাদিন বকবক করতো যেই ছেলে, সে হঠ্যাৎই চুপ হয়ে যায়। খুবই ভয় পেয়ে যান তিনি।
ওকে আক্রান্ত কোন ব্যাক্তি আক্রমন করেছে, তাই তার ছেলেও ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। কি করবে এখন সে? আয়েশা বেগম খুবই চিন্তায় পড়ে যান, প্রিয়ার জন্যও খুব চিন্তা করতে থাকেন, কারন ও তো ছেলের সাথেই থাকে। যেকোন সময় প্রিয়া বা তার উপর আক্রমন করতে পারে। নিজের ছেলে, তাই বের করে দিতেও পারছে না। বসে বসে কাঁদছেন, হেঁ আল্লাহ, এ কোন পরিক্ষায় ফেললে?
--মা, কাঁদছেন কেনো?(প্রিয়া)
--আমার ছেলে যে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গেছে। কি করবো এখন?
--কি বলছেন মা?
--ওর দিকে দেখো....
প্রিয়া মামুনের দিকে তাকায়, বুঝতে পারে আসলেই কথা সত্য। আয়েশা বেগম ভেবে চিন্তে মামুনের হাত পা শিকল দিয়ে বেধে ফেলে।
--শুনো বৌমা, তুমি ওর কাছে যেও না, রাতে আমার সাথেই থাকবে।
--কি বলছেন মা? ওনাকে এই অবস্থায় একা রাখবো?
--তুমি ওর কাছে গেলে ও তোমার ক্ষতি করতে পারে।
--উনি আমার স্বামী, আমার কিচ্ছু করবে না।
--বৌমা, তুমি বোঝার চেষ্টা করো। ও ভাইরাসে আক্রান্ত। ও কি করবে তা ও নিজেও জানে না। ও এখন ওর মধ্যে নেই।
--উনি যাই হোক, ওনাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। আমার দায়িত্ব ওনার বিপদে ওনার পাশে থাকা।
আয়েশা বেগম ভীষন রকমের ভয় পেয়ে যান। ছেলের এই অবস্থা, এখন বৌয়ের যদি কিছু হয়ে যায়।মামুন এখনো স্বাভাবিক, শুধু কথা বলেনা। প্রিয়া ওকে হাতে তুলে খাইয়ে দেয়। প্রিয়া নিজে নিজে ওর সাথে কথা বলে, কিন্তু মামুনের দিক থেকে কোন জবাব আসে না। রাতে আয়েশা বেগম প্রিয়াকে অনেক জোর করে মামুনের রুমে না থাকার জন্য। প্রিয়ার এক কথা, ও মামুনকে বিপদে রেখে যাবে না।
মামুনের হাত পা শিকল দিয়ে বাধা, প্রিয়া পাশেই শুয়ে আছে।
--আপনি কি আমার ওপর রাগ করেছেন?(প্রিয়া)
--
--কথা বলছেন না কেনো আমার সাথে?
--
--আমার যে আপনার সাথে কথা না হলে কান্না পায়। আমার কান্না আসছে।
--
--কিছু বলুন না।
--
--আপনাকে বাহিরে যেতে দেওয়াটাই উচিত হয় নি। আপনি এখন কথা না বললে আমি কিন্তু আর কখনো আপনার সাথে কথা বলবো না।
--
প্রিয়া মামুনের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। আয়েশা বেগম একটু পর পর এসে দেখে যায় মামুনের কি অবস্থা। রাতে তেমন কিছু হয় নি। সকালে প্রিয়া রান্না করছিলো, আয়েশা বেগম মামুনকে দেখতে ওর রুমে যায়। খেয়াল করে মামুন কেমন যেনো হিংস্র হয়ে উঠছে। সাইটের দাঁতগুলো বড় হয়ে যাচ্ছে। আয়েশা বেগম ছেলের এমন অবস্থা দেখে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারান।
প্রিয়া দৌড়ে আসে। এক পাশে শাশুড়ি পড়ে আছে, অন্য দিকে মামুনের শরীর কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছে। মামুনকে এভাবে দেখে প্রিয়া প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়। তবুও মনে সাহস নিয়ে শাশুড়িকে ওনার রুমে নিয়ে শুইয়ে দিয়ে আসে। পাশের রুম থেকে মামুনের গর্জন শুনা যাচ্ছে। ঘরে প্রিয়া একা, শাশুড়ি অজ্ঞান, স্বামীর এমন অবস্থা। প্রিয়াও ৭ মাসের প্রেগন্যান্ট, সে কি করবে এখন? কোন উপায় না পেয়ে মামুনের কাছে যায়। মামুন প্রিয়াকে দেখে পশুর মতো জোরে জোরে গর্জন করতে থাকে।
বেঁধে রাখার কারনে প্রিয়ার কাছে আসতে পারছে না।
--কি চান আপনি? আমাকে মারবেন?
--
--আমার সন্তানকে মারবেন? এটা তো আপনি আমানত হিসেবে আমার কাছে রেখেছেন। জীবন থাকতে এই আমানতের কোন ক্ষতি হতে আমি দেবো না।
--(মামুন আরো জোরে গর্জন করতে থাকে, প্রিয়ার দিকে আসতে চায়)
প্রিয়া বুঝতে পারে বেঁধে রাখার কারনে ওকে ছুতে পারবে না।
এই গর্জনটা ওর কাছে অসহ্য লাগে।
--চুপ করুন...( মনে ভয় নিয়ে জোরে ধমক দেয়)
--(হিংস্র মামুন নিমিষেই চুপ হয়ে যায়)
--কি শুরু করেছেন আপনি? অসহ্য লাগছে। চুপ করে এখানে বসে থাকুন। (বলেই শাশুড়ির ঘরের দিকে যাচ্ছিলো)
--
--আর হ্যা, আবার যদি আপনার আওয়াজ শুনি, তাহলে আপনার খবর আছে বলে দিলাম।
প্রিয়া শাশুড়ির কাছে আসে।
এই প্রথম প্রিয়া মামুনকে ধমক দিলো, ভীতু হয়েও স্বামীকে সাহস দেখালো, উচু আওয়াজে কথা বললো। মনে মনে ভাবে,, ধমক দিলাম, ওমনি চুপ হয়ে গেলো? ঘটনা কি?
শাশুড়িকে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরায়।
--মা, এখন কেমন লাগছে?
--মামুনকে দেখেছো? কেমন হয়ে গেছে ও...
--হ্যা মা, আমি দেখেছি। এখন ঠিক আছে, আপনি ওই রুমে যাবেন না।
--ও শিকল ভেঙে ফেলবে না তো?
--কিভাবে? ওনার হাত, পা সব বাঁধা।
--তুমি সাবধানে থেকো।
--হুম....
একটু পর প্রিয়া আবার মামুনকে দেখতে রুমে আসে। মামুন ঘুমাচ্ছে, প্রিয়া খেয়াল করলো ও আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেছে, যেনো কিছুটা সস্তি পায় প্রিয়া। রাতে আবার মামুনকে হাতে তুলে খাইয়ে দেয়। শেষে ওর সাথে শুয়ে পড়ে। আয়েশা বেগম প্রিয়াকে নিয়ে খুবই চিন্তায় থাকেন। প্রিয়া মামুনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা ওর বউকেই যেনো চিনতেছে না। যেই মেয়ে সামান্য বিষয়ে এতো ভয় পেতো, সে যেনো মামুনের এমন অবস্থায় কোন ভয়ই পায় না।
--কি দেখছেন? ঘুমাবেন না?(প্রিয়া)
--(মামুন প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে)
--আমি যদি আপনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাই আপনি কি আমার ঘাড়ে কামড় দিয়ে মেরে ফেলবেন?
--
--(মামুনের বাঁধা হাতটা ওর পেটে রাখলো) এটা আপনার সন্তান,আপনার রক্ত। আমাকে মেরে ফেললে যে আপনার এই আমানত আমি রক্ষা করতে পারবো না। আমি যে আপনার কাছে অপরাধী হয়ে যাবো। আমাকে অপরাধী বানাবেন না।
--
--আমি দেখতে চাই, কার ক্ষমতা বেশী, আপনার? নাকি আমাদের ভালেবাসার...যদি আমাদের ভালোবাসার ক্ষমতা বেশী হয়, তাহলে আপনি আমার কিচ্ছু করতে পারবেন না।
--
--আমি ঘুমাবো, শুধু আমার স্বামীর ভরসায়.....(মামুনের গলা জড়িয়ে ধরলো)
প্রিয়া মামুনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। মধ্যরাতে মামুনের নেশা উঠেছে, এই যে খুনের নেশা। হাত বাঁধা, কিন্তু ওর দাঁতগুলো বড় হয়ে যাচ্ছে। প্রিয়ার গলাটা যে ওর দাঁত থেকে খুব বেশী দুরে নয়, কোন এক অজানা শক্তি মামুনকে ধীরে ধীরে প্রিয়ার গলার কাছে নিয়ে আসছে..............
লেখক :- আবদুল্লাহ আল মামুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Give your opinion, please!